মোঃ আবদুর রহমান
রকমেলন মরু অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় ফল। সৌদি আরবে এ ফলকে ‘সাম্মাম’ বলে। এ ফলের ওপরের ত্বক পাথর এর মতো, তাই অস্ট্রেলিয়ায় একে ’রকমেলন’ বলা হয়। কোনো কোনো দেশে এটি খরমুজ, খরবুজ, ক্যান্টালোপ, সুইট মেলন, মাস্ক মেলন, হানিডিউ মেলন ইত্যাদি নামেও পরিচিত। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রকমেলন বেশ জনপ্রিয়।
মরুভূমির জনপ্রিয় ফল রকমেলন চাষ করে প্রথমবারই সফল হয়েছেন আদর্শ কৃষক ক্ষিতিষ বৈরাগী (৪৮)। তিনি রূপসা উপজেলার ডোবা গ্রামের বাসিন্দা। ঘেরের পাড়ে উচ্চমূল্যের এ ফল চাষ করে স্বল্প সময়ে অধিক ফলন ও ভালো দাম পেয়ে ক্ষিতিষ বৈরাগী দারুণ খুশি। তার এমন সাফল্য দেখে এলাকার আরো অনেক চাষি রকমেলন ফল চাষে উৎসাহিত হয়েছেন।
সরেজমিন জমিতে গিয়ে দেখা যায়, ঘেরের পাড়ে মাচায় ঝুলছে নানা রঙের ছোট-বড় রকমেলন ফল। আবার কোনো কোনো গাছে ফুটেছে ফুল। পুরো জমিটি সবুজে ঘেরা। ক্ষেতে রকমেলন গাছের পরিচর্যা করছেন ক্ষিতিষ বৈরাগী। এ সময় তার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, গত বছর ভারতের দিল্লি শহরে গিয়েছিলেন। সেখানে রকমেলন ফল খেয়ে দারুণ তৃপ্তি পেয়ে নতুন এ ফল চাষে তার ইচ্ছে জাগে। সেই ইচ্ছে বাস্তবে রূপ দিতে দেশে ফিরে তিনি এ বছর মৎস্য ঘেরের পাড়ে ১০ শতক জমিতে রকমেলন চাষ করেন।
ক্ষিতিষ বৈরাগী আরো বলেন, বর্ষার পানিতে ডুবে না যায় এ ধরনের উঁচু ঘেরের পাড়ের বেলে দো-আঁশ মাটি এ ফল চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে। ঘেরের পাড়ে ২ হাত দূরে দূরে সারি করে প্রতি সারিতে ২ হাত পর পর ২০ সেমি. চওড়া ও ২০ সেমি. গভীর করে মাদা তৈরি করতে হয়। তারপর প্রতি মাদার ওপরের স্তরের মাটির সাথে ২৫০ গ্রাম পঁচা গোবর, ২০ গ্রাম টিএসপি, ১৫ গ্রাম এমওপি ও ৫ গ্রাম ব্রিফার-৫ জি (দানাদার কীটনাশক) ভালোভাবে মিশিয়ে মাদা পুনরায় ভরাট করতে হবে। ঘেরে পাড়ের দুই পাশে মাদা তৈরি করতে হয়। মাদায় সার প্রয়োগের ৭-৮ দিন পর প্রতি মাদায় ২টি অংকুরিত বীজ ১ইঞ্চি (২.৫ সেমি.) গভীরে বপন করা হয়। বীজ বপনের সময় শীত আসার পূর্বে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর (ভাদ্র-কার্তিক) অথবা মার্চ থেকে জুন (ফাল্গুন-আষাঢ়)। চারা গজানোর ১০-১২ দিন পর প্রতি মাদায় ১টি সুস্থ ও সবল চারা রেখে বাকিগুলো উঠিয়ে ফেলতে হবে।
তিনি বলেন, রকমেলনের ভালো ফলনের জন্য ইউরিয়া ও এমওপি সার তিন ভাগে ভাগ করে চারা গজানোর ১৫ দিন পর প্রথম, ৩০ দিন পর দ্বিতীয় এবং ৫০ দিন পর তৃতীয় কিস্তিতে উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। প্রতি কিস্তিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০ গ্রাম এমওপি সার গাছের গোড়া থেকে ১৫ সেমি. দূরে চারদিকে উপরিপ্রয়োগ করে ঝুরঝুরে শুকনো মাটি দিয়ে এ সার ঢেকে দেওয়া হয়। প্রতিবার সার উপরিপ্রয়োগের পর মাদায় ঝাঝরি দিয়ে পানি সেচ দিতে হয়। তাছাড়া মাটিতে রসের অভাব হলে রকমেলন গাছে নিয়মিত পানি সেচ দিতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে চারা গাছ অতিবৃষ্টি অথবা অতিরিক্ত পানি সহ্য করতে পারে না। আবার গাছের গোড়ায় আগাছা হলে নিয়মিত নিড়ানি দিয়ে তা তুলে ফেলতে হয়। ক্ষিতিষ বৈরাগী বলেন, রকমেলন গাছে লেদাপোকা আক্রমণ করে পাতা ও লতা খেয়ে ফেলে। ভলিয়াম ফ্লেক্সি-৩০ এসসি নামক কীটনাশক (প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলি. হারে) গাছে নিয়মিত স্প্রে করে এ পোকা দমন করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
এভাবে কৃষক ক্ষিতিষ বৈরাগী রকমেলন চারাগুলোর পরম যত্ন করেছেন। এতে চারাগুলো ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে লতিয়ে যায়। গাছ বা লতা ২ হাত লম্বা হলে তা ঘেরের পাড়ে তৈরি মাচায় তুলে দিতে হবে। এতে গাছ মাচায় লতিয়ে বা ছড়িয়ে পড়ে ভালো ফুল ও ফল দিতে পারে। বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর গাছে ফুল এবং ৪০-৪৫ দিন পর ফল ধরা শুরু হয়। আর ৬৫-৭০ দিন পর ফল সংগ্রহ করা হয়। ক্ষিতিষ বৈরাগী বলেন, প্রতি গাছে ৫-৬টি ফল ধরেছে এবং এক একটি ফলের ওজন হয়েছে গড়ে ১-৩ কেজি। ফল বড় হওয়া শুরু হলে যাতে ছিঁড়ে না পড়ে সেজন্য তা থলের মতো নেটের ব্যাগ দিয়ে মাচার সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। তার জমিতে উৎপন্ন অধিকাংশ ফল দেখতে ঘিয়ে রঙের গোলাকার এবং ভেতরের শাঁস হালকা হলুদ, অনেকটা আমাদের দেশীয় ফল বাঙ্গির মতো। এফল খেতে বেশ সুস্বাদু, মিষ্টি ও সুগন্ধিযুক্ত। ঘেরের পাড়ের ১০ শতক জমিতে রকমেলন চাষে বীজ, মাদা তৈরি, সার, মাচা তৈরি, শ্রমিক ও কীটনাশক বাবদ তার মাত্র ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। বীজ বপনের দুই মাস পর থেকে তিনি ফল বিক্রি শুরু করেন। এ জমি থেকে তিনি ১৭০ কেজি রকমেলন উৎপন্ন করে তা পাইকারি বাজারে ১০০ টাকা কেজি দরে মোট ১৭ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এতে তার উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ১২ হাজার টাকা লাভ হয়েছে বলে তিনি জানান। উপরন্তু তিনি ২ হাজার টাকার বীজ বিক্রি করেছেন। রকমেলনের ভালো ফলন ও দাম পেয়ে খুশিতে ভরে উঠছে কৃষক ক্ষিতিষের মন।
রূপসা উপজেলা কৃষি অফিসার জনাব মোঃ ফরিদুজ্জামান বলেন, ক্ষিতিষ বৈরাগী একজন উদ্যমী চাষি। তিনি উপজেলায় প্রথম নতুন ফসল রকমেলন চাষ করে সাফল্য পেয়েছেন। তার ক্ষেত পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে তাকে সহযোগিতা করা হয়েছে। তার এ সফলতা দেখে এলাকার আরো অনেক চাষি এ ফল চাষে আগ্রহী হয়েছেন। ক্ষিতিষ বৈরাগী ছাড়াও ডোবা গ্রামের তন্ময় ও শ্যামল, গোয়াড়ার অংশু ও বলটি গ্রামের দীপ এ বছর প্রথম মৎস্য ঘেরের পাড়ে রকমেলন চাষ করেছেন। রকমেলন একটি লাভজনক ফসল। তাই আগামী বছর উপজেলায় এ ফসলের চাষ আরো বাড়বে বলে তিনি আশা করেন।
নানা রঙের রকমেলন ফল দেখা যায়। একটি ঘিয়ে রঙের গোলাকার, ভেতরের শাঁস হালকা হলুদ অনেকটা দেশীয় ফল বাঙ্গির মতো। আরেকটি বাদামি রঙের ধূসর, খোসা খসখসে ওপরে জাল-জাল দাগ থাকে। এর ভেতরের খাদ্য অংশ গাঢ় হলুদ। অন্য আরেকটি ফল দেখতে হালকা সবুজ রঙের গোলাকার। খোসা খসখসে গায়ে জাল জাল দাগ আছে। এর ভেতরের শাঁসও গাঢ় হলুদ। রঙ ও আকৃতি যেমনই হোক, সব রকমের ফলই পুষ্টিকর, খেতে সুস্বাদু, মিষ্টি ও সুগন্ধ যুক্ত।
রকমেলন ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি এবং ক্যালসিয়াম, লৌহ, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও জিংক রয়েছে। এতে থাকা ভিটামিন এ, সি এবং বিটা-ক্যারোটিন চোখের দৃষ্টিশক্তি ও ত্বককে ভালো রাখে এবং শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। আঁশ সমৃদ্ধ শর্করা থাকায় এ ফল রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়তে দেয় না। এতে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। রকমেলনে থাকা পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভালো কাজ করে। তাছাড়া এ ফলে জিংক আছে। দেহ কোষের গঠন ও বৃদ্ধিতে জিংক সহায়তা করে। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে জিংকের খুব প্রয়োজন। মুখের রুচি বাড়াতেও এটি কার্যকর ভূমিকা রাখে।
রকমেলন খুব রসালো ফল। এতে শতকরা ৯৫ ভাগ জলীয় অংশ থাকায় এটি মানব দেহের পুষ্টি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি শরীর ঠা-া রাখতে সাহায্য করে। এ ফল খাবারকে হজম করতে সহায়তা করে। রকমেলনে থাকা লুটেইন ও ফ্ল্যাভোনয়েডস উপাদান ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। চুল ও ত্বকের জন্যও এ ফল উপকারী। তবে ডায়াবেটিক ও কিডনি রোগীদের এ ফল খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত।
বিদেশী এ ফল বর্তমানে বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপখাইয়ে নিয়েছে। তাই আমাদের দেশেও এখন রকমেলন চাষ শুরু হয়েছে। এ ফলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এবং এর বাজারমূল্যও বেশি। তাই এর চাষ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এজন্য রকমেলন ফল চাষে কৃষক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া একান্ত আবশ্যক।
লেখক : উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি অফিস, রূপসা, খুলনা। মোবাইল : ০১৯২৩৫৮৭২৫৬; ই-মেইল :rahman.rupsha@gmail.com