ফেনী সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে সোনাগাজী উপজেলার মুহুরী সেচ প্রকল্প। ফেনী নদীসংলগ্ন এই প্রকল্প এলাকায় গড়ে উঠেছে অসংখ্য মৎস্য খামার। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলাঘেঁষা ফেনীর সীমান্তবর্তী মুহুরী প্রকল্প এলাকাটি ছিল অপরাধচক্রের নিরাপদ ভূমি। উঁচু-নিচু, অনাবাদি বনভূমিতে অসংখ্য মৎস্য খামার গড়ে উঠেছে। যার শুরু ফেনী সদর উপজেলার মুজিবুল হক রিপনের হাত ধরে। প্রায় ২২ বছর আগে (২০০১ সালে) মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকায় ফেনী নদী লাগোয়া প্রায় ৮ একর অনাবাদি উঁচু-নিচু জায়গায় দু’টি পুকুর কেটে শুরু হয় মৎস্যচাষ। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে লিজ নিয়ে মৎস্য খামার গড়ে তোলেন। মুজিবুল হক রিপন টানা তিন মেয়াদে ফেনী সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। গত বছর তিনি পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার। এলাকায় তিনি রিপন চেয়ারম্যান নামেই পরিচিত। তিনি বলেন, মৎস্য খামার শুরুর দিকে ছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জমি লিজ নিলেও তা দখলমুক্ত করার প্রথম চ্যালেঞ্জ উতরাতে হয় তাকে। বিভিন্ন এলাকায় চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করে সেখানেই বণ্টন হতো। অপরাধচক্রের আড্ডার সেই জায়গায় ছোট খামারের পরিধি বেড়েছে। প্রায় ৩০ একর জায়গায় ১০টি পুকুর তার। জায়গাটি নিরাপদ করতে অনেক ধকল সইতে হয়েছে রিপন চেয়ারম্যানকে। তিনি বলেন, একটা সময় দেখা যেত দুর্বৃত্তরা ট্রাক বোঝাই করে মাছ নিয়ে যেত। পুকুরে বেড় দিয়ে মাছ মেরে নিত। এখন আর সে দিন নেই। আমার সাথে প্রায় একই সময়ে আরো কয়েকজন মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় মৎস্য চাষ শুরু করেন। এখন তো মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় যে দিকে তাকানো যায় শুধু পুকুর আর পুকুর। দেশের অন্যতম মৎস্য ভাণ্ডার হয়ে উঠেছে।
মুজিবুল হক রিপন জানান, এই মৎস্য খামার থেকে বছরে ৭০ লাখ থেকে কোটি টাকা লাভ হয়। মাছের পাশাপাশি পুকুরপাড়ে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, নারিকেল গাছসহ বিভিন্ন ফলদ গাছ লাগিয়েছি। সেখান থেকেও ইনকাম আসে। মাছের এই প্রজেক্টের কারণেই আমি বঙ্গবন্ধু কৃষি পদকটা পেয়েছি। এখানে একটা হ্যাচারি করার জন্য চেষ্টা করছি। ভবিষ্যতে হ্যাচারি এবং মাছের চাষ দুটোই পরিপূর্ণতা দিতে পারব বলে বিশ্বাস করি।
মুজিবুল হক রিপন শুধু মৎস্য খামারেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি এখন ফেনী সদরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি কৃষি খামার। গড়েছেন নার্সারিও। এখন তিনি পার্বত্য খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটিতে কৃষি খামার করতে সার্বিক কার্যক্রম শুরু করেছেন। কৃষি খামার, মৎস্য খামার, অ্যাগ্রো ফার্ম, হাঁস-মুরগির খামার, নার্সারি, ফলের বাগান, কৃষি উৎপাদন ও বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অসংখ্য বেকার যুবকের কর্মসংস্থান করেছেন মুজিবুল হক রিপন চেয়াম্যান।
সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার মুহুরী নদীর পাড়ে পূর্ব ফাজিলপুর গ্রামের জলদাস পাড়াসংলগ্ন মুহুরী ব্রিজের পাশেই বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রায় ৫ একর অনাবাদি জায়গায় গড়েছেন বাহারি ফলের বাগান, হাঁস-মুরগির খামারসহ অ্যাগ্রো ফার্ম। এখানকার ফলের বাগানে রয়েছে বারোমাসি আম, রুপালি, বেনানা ম্যাংগো, হিম সাগরসহ নানা জাতের আম। থাই পেয়ারা, কাজী পেয়ারা, দেশী পেয়ারা, চায়না লেবু, কমলা লেবু, শরবত লেবু, উফশী লেবু, রেড লেডি পেঁপে, নাইন-খাটো জাতের পেঁপে, আপেল কুল, নাইন কুল, দেশী জাতের বরই, দেশীয় লাল জাতের কলা, অগ্নিশ্যার কলা, ভিয়েতনামের নারিকেল কলা। এ ছাড়া রয়েছে বরবটি, ঝিঙে, তিত করলা, ঢেঁড়শ ও বেগুনসহ বিভিন্ন রকম শাকসবজি।
সদর উপজেলার কালিদাস পাহালিয়া নদী পাড়ে প্রায় ১৬.৫০ একর বিস্তীর্ণ অনাবাদি জমিতে পাহালিয়া অ্যাগ্রো পার্ক প্রতিষ্ঠা করে এলাকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। বনজঙ্গলে ভরা অনাবাদি এই জমিতে জি-নাইন কলা, রঙ্গিলা সাগর কলা, মেহের সাগর কলা, সবজি কলা ও দেশীয় জাতের প্রায় এক হাজার ২০০ কলা গাছ রয়েছে। পেঁপে বাগানে লালতীরের বাবু, ইস্পাহানি কিং, ইস্পাহানি কুইং, ট্রাম্প, সুইট লেডি, টপ লেডি, রেড জয়সহ প্রায় তিন হাজার ৫০০টি চারা রোপণ করা হয়েছে। পেয়ারা বাগানে বারোমাসি পেয়ারা, থাই ফাইভ, গোল্ডেন এইট জাতের তিন হাজার ৫০০টি চারা। কুল (বরই) বাগানে বল সুন্দরী, থাই কুল, টক-মিষ্টি জাতের পাঁচ হাজার চারা রোপণ করা হয়েছে। লেবু বাগানে চায়না থ্রি, এলাচি লেবু, সিট লেছ কাগজি লেবুর এক হাজার ৫০০ চারা রোপণ করা হয়েছে। আম বাগানে রয়েছে বারি ফোর, কাটিমনসহ বিভিন্ন প্রজাতের ১৭০টি আম গাছ।
নিজ গ্রাম ফাজিলপুরে গড়ে তুলেছেন বিশাল গবাদি পশুর খামার। এই খামারে দেশী-বিদেশী উন্নত জাতের গবাদি পশু রয়েছে। প্রতিদিন শত শত লিটার দুধ বিভিন্ন অঞ্চলে সাপ্লাই দেয়া হয় বলে রিপন চেয়ারম্যান জানান।
এ ছাড়া ফাজিলপুর ইউনিয়নের উত্তর শিবপুর গ্রামে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার রাস্তার ধারে বাসক, পুঁদিনা, অর্জুন, তুলসী ও নিম গাছ লাগিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। রাস্তার দুই পাশে এসব ঔষধি গাছের পাতা বা ছাল সংগ্রহ করতে নিজ ইউনিয়ন তো বটেই জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ছুটে যাচ্ছেন।
সব কিছু মিলে রিপন চেয়ারম্যান একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা এবং আদর্শবান জনপ্রতিনিধি হিসেবে এলাকার গণ্ডি ছাপিয়ে সুনাম ছড়াচ্ছেন।
ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মুজিবুল হক রিপন বলেন, ছোটবেলা থেকেই কৃষিকাজ যেমন গাছপালা, মাছ ধরা, পশুপালনের সাথে অভ্যস্ত ছিলাম। এটি অনেকটা আমার নেশা বলতে পারেন। সেখান থেকেই আমার মৎস্য ও কৃষি উদ্যোক্তা হওয়া। তিনি বলেন, যখন আমি জনপ্রতিনিধি (চেয়ারম্যান) নির্বাচিত হই তখন দেখলাম, কৃষিতে কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। কৃষিতে বর্তমান সরকার প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। চেয়ারম্যান হওয়ার সুবাদে বুঝতে পারলাম তৃণমূল পর্যায়ে কৃষিকে ছড়িয়ে দেয়া যায়। আমার এখানে যে অনাবাদি, পরিত্যক্ত জায়গাগুলো আছে, সেগুলোকে আমি কৃষির আওতায় নিয়ে আসতে পারি। সেই জায়গা থেকে প্রথমে আমি নিজে এটি করা শুরু করলাম। জনপ্রতিনিধি হিসেবে যখন আমি এসব করি, তখন তো অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়। আমি উদাহরণ হওয়ার চেষ্টা করলাম। আমি এখন নতুন প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। বিনামূল্যে পাঁচ হাজার সজিনা গাছের চারা বিতরণ করব। প্রথমে নিজ ইউনিয়নে, পরে অন্য জায়গায়ও শুরু করব। সার্বিকভাবে একজন জনপ্রতিনিধি যদি কৃষি ও মৎস্য খাতে জড়িত হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ আগ্রহী হবে। নিজ এলাকার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলাতেও কৃষি প্রজেক্ট ছড়িয়ে দিতে চাই। আমি একটা জিনিস করছি, সেটি হলো সমবায়ের ভিত্তিতে কিছু লোককে একত্রিত করছি। আমি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছি। কোন গাছটা কোথায় ভালো হয়, কোথায় কোন পশু পালন ভালো হয়, সেখানকার পরিবেশ ও আবহাওয়া উপযোগী উদ্যোগ নিচ্ছি।