জন্মের পর থেকেই সবুজের মায়া, সবুজের হাতছানিতে বেড়ে ওঠা। যতই এদিক-ওদিক ডাক পড়েছে, মনটা ওই সবুজের কাছে, কৃষিতেই পড়ে রয়েছে। আরও উন্নত কিছুর আশা নিয়ে দেশও ছেড়েছেন। সমুদ্রের ওপারে চলে গেলেও মন থেকে কৃষির প্রতি টান, মায়া কিছুই কমেনি।
প্রায় ১৪ বছর প্রবাসে কাটানো মানুষটা যখন দেশে ফিরলেন, তাঁর বাড়ি, বাড়ির আশপাশের জমিজমা আবার তাঁকে জাগিয়ে তুলল। জড়িয়ে পড়লেন মাটির সঙ্গেই। তাঁর হাতে আনন্দ-উৎসবের মতো ফলতে লাগল বৈচিত্র্যের নানা ফসল। মৌলভীবাজারের বড়লেখার ঘোলসা গ্রামের জাকির হোসেন এই কৃষি থেকেই এখন বছরে আয় করেন সাত থেকে আট লাখ টাকা। নির্মল খোলা হাওয়া, ফসলের মাঠেই এখন তাঁর দিন কাটে। জাকির কৃষির যেকোনো নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে একজন অগ্রসর চাষি, অগ্রপথিক।
সম্প্রতি ঘোলসা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে ছড়ানো সবুজের ভেতর একটি একতলা বাড়ি। বাড়ির বিভিন্ন দিকের খেতে ঝকঝক করছে সবুজ শস্য-ফসল। বাড়ির উঠানসংলগ্ন স্থান থেকে যেদিকেই চোখ যায়, নানা রকমের সবজি, মৌসুমি ফসলের গাছগাছড়া। কী নেই!Ñবেগুন, করলা, পেঁপে, লাউ। মাল্টা, লেবু, আম আরও কত কী। বাড়ির সঙ্গেই পুকুরপাড়ে লাগিয়েছেন লাউয়ের গাছ। সেই গাছকে পুকুরপাড় ঘেঁষে মাচা তৈরি করে বাড়তে দিয়েছেন। মাচায় লকলক করছে লাউয়ের ডগা। ঝুলে আছে লাউ। ঘরের কাছেই পেঁপেগাছ। বাড়িসংলগ্ন জমিতে টমেটোখেত। হলুদ তরমুজ ঝুলে আছে বাঁশ ও জালের খাঁচায়। প্রখর রোদে ঝলমল করছে তরমুজের হলুদ শরীর। একজন শ্রমিক একা আনমনে বেড়ে ওঠা হলুদ তরমুজ লাল রঙের কাপড়ের ব্যাগের মধ্যে পুরে ঝুলিয়ে দিচ্ছেন। যাতে তরমুজে পোকামাকড়ের আক্রমণ না হয়, তরমুজের শরীরে দাগ না পড়ে। জাকিরের এই শাকসবজি ও ফলমূলের সাম্রাজ্য কৃষির প্রতি তাঁর ভালোবাসা, তাঁর মেধা ও শ্রমের প্রকাশ হয়ে হাসছে।
জাকির বলেন, ‘আমার খেতের ফসলের চাহিদা আছে বড়লেখায়। বাজারে জাকিরের লাউ শুনলে কেউ আর প্রশ্ন তোলে না, দরদাম না করেই নিয়ে যায়।’
এই কৃষি উদ্যোক্তা জাকির বলেন, উন্নত জীবনের আশায় ২০০০ সালে তিনি সৌদি আরব চলে যান। সৌদি আরবে ভালো কাজ থাকা সত্ত্বেও ২০১৪ সালে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে ২৪ শতক জমিতে একটি মিশ্র ফলবাগান করেন। এই বাগানে ছিল কমলা, সফেদা, লিচু, আমসহ বিভিন্ন জাতের ৬০টি গাছ। এর মধ্যে ছিল দুটি মাত্র মাল্টাগাছ। তিন বছর পর এই দুটি মাল্টাগাছে প্রায় ২০০ কেজি মাল্টা ধরে। মাল্টার এই ফলন তাঁর চিন্তাভাবনাকে বদলে দেয়। আগ্রহী হয়ে ওঠেন মাল্টা চাষে। ২০১৭ সালে তিনি শুরু করেন মাল্টার বাণিজ্যিক চাষ। তাঁর এখন শাকসবজি ও অন্য ফসল মিলিয়ে বাড়িকেন্দ্রিক বড় এক সাম্রাজ্য তৈরি হয়েছে। বাড়িসংলগ্ন জমিতে মৌসুমি সবজির চাষ করছেন।
বাড়ির কাছেই নতুন ফসল হিসেবে তিনি ১৫ শতক জমিতে সানগোল্ড জাতের ৭০০ হলুদ তরমুজের চারা লাগিয়েছিলেন। এই হলুদ তরমুজখেত করতে তাঁর খরচ হয়েছিল ৩৫ হাজার টাকা। এই খেত থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করেছেন।
হলুদ তরমুজ চাষ সম্পর্কে জাকির হোসেন বলেন, ‘উপজেলা (বড়লেখার) কৃষি কর্মকর্তা (মনোয়ার হোসেন) হলুদ তরমুজ চাষে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেন। এখন শীতকালীন কিছু তরমুজ লাগিয়েছেন। নতুন আরও একটি জাতের তরমুজ চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
জাকির হোসেন আর বলেন, তিনি মৌসুমি শাকসবজি ও ফল-ফসলের চাষ করেন। তাঁর দুই বাগানের ৯০ শতক জমিতে আছে মাল্টা। গেল মৌসুমে তিনি প্রায় তিন লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করেছেন। ২০ শতকের লেবুবাগান থেকেও প্রায় তিন লাখ টাকার লেবু বিক্রি করেছেন। পুকুরে তৈরি মাচায় উৎপাদিত লাউ বিক্রি করেছেন প্রায় দেড় লাখ টাকার। পেঁপে বিক্রি করেছেন ৪০ হাজার টাকার। সাত শতক জমিতে বেগুন চাষ করেছেন। এরই মধ্যে ৮০ হাজার টাকার বেগুন বিক্রি করেছেন। এখনো বেগুন বিক্রি হচ্ছে। ২৭ শতকের দুই খেতের করলা বিক্রি করেছেন দেড় লাখ টাকার। আম বিক্রি করেছেন প্রায় ৪০ হাজার টাকার। এ ছাড়া টমেটো, বাদাম, মাষকলাই, আলু, ক্যাপসিকামসহ নানা রকম মৌসুমের সবজি আছে তাঁর বাগানে। সব খরচ বাদ দিয়ে এই সবজি, ফল-ফসল থেকে বছরে সাত থেকে আট লাখ টাকা আয় করেন তিনি।
বড়লেখা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অনেক কৃষক নতুন ফসল দেরিতে গ্রহণ করেন। উনি (জাকির হোসেন) নতুন ফসল পেলেই চাষ করেন। শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে ফসলের সঙ্গে লেগে থাকেন। নতুন ফসল দ্রুত গ্রহণ ও সম্প্রসারণের কাজ করেন, এ রকম উদ্যোক্তা পাওয়া যায় না।’