Engage Your Visitors!

Click here to change this text. Lorem ipsum dolor sit amet, consectetur adipiscing elit. Ut elit tellus, luctus nec ullamcorper mattis, pulvinar dapibus leo.

কোনো মানুষের ‘চাওয়া’ এত কম হয় কীভাবে

দুটি ছোট আকারের ঝুড়ি। একটিতে কেজি ছয়-সাত বরই। অন্যটিতে তিন পদ—বিট, শাকালু ও বোম্বাই মরিচ। বিট হবে কেজি চারেক, শাকালু দুই-আড়াই কেজি আর বোম্বাই মরিচ আধা কেজির মতো। সারা দিনের বিক্রিবাট্টা শেষে তখনো এই পরিমাণ পণ্য অবিক্রিত।

সন্ধ্যা তখন আসছি আসছি করছে, ঘড়ির কাঁটায় সোয়া পাঁচটা—সব মিলিয়ে সকালে রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে ২ হাজার ১০০ টাকার পণ্য কিনেছিলেন আবুল বাশার। তখন পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ টাকার পণ্য বিক্রি করতে পেরেছেন। অর্থাৎ, চালান উঠতে বাকি ৭০০ টাকা। এর ওপর যা আসবে, তা-ই লাভ, অর্থাৎ সেটাই হবে তাঁর সেদিনের আয়।

‘শীতের কামড়’ বলতে যা বোঝায়, মাঘকে গত কয়েক দিন তেমনই তীব্রভাবে টের পাওয়া গেছে! দেশজুড়ে সবারই কাপুঁনি ধরিয়ে দিয়েছিল দাপুটে ঠান্ডা। আগাপাছতলা কংক্রিটে মোড়া ঢাকা শহরও এতটুকু তেঁতে উঠছিল না, সেদিন ১৭ জানুয়ারিও সারা দিন ছিল শীতের দখলে। দিন যত ঢলে পড়ছিল, তাপমাত্রার পারদ যেন তত নামছিল।

সূর্য তার মুখ না দেখানোয় খাড়া দুপুর আর হেলে পড়া সন্ধ্যার তেমন ফারাক করা যাচ্ছিল না। নেহাত শহরে বিজলিবাতির ঝকমকি থাকে, তাই একটু আগেভাগে সড়কের দুই পাশের দোকানপাটে ফটাফট বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠছিল।

এমন একটা দিনের শেষ ভাগে আবুল বাশারের বাকি পণ্যগুলো বিক্রি হবে—ভরসা হয় না; মনের ভেতর কেমন সন্দেহের চোরা কাঁটা খচখচ করে! প্রশ্নটা তুলতেই তাঁর অমলিন হাসি বুদ্ধদেব বসুর ‘ডাইনি-হাওয়ার কনকনে চাবুক গালের মাংস ছিঁড়ে নেয়’ চরণখানি যেন মিথ্যে করে দিল! প্রচণ্ড শীতেও একটা সাধারণ মানের জ্যাকেট আর লুঙ্গি পরা, মাথায় গামছাটা জড়িয়ে নিয়েছেন বাড়তি হিসেবে।

শীতে কাঁপতে কাঁপতেও অকপটে বললেন, সব বিক্রি শেষ করেই ঘরে ফিরবেন। আঞ্চলিক টানে তাঁর উচ্চারণ বড় মধুর—‘কিছুই থাকত না, সব বিকরি কইরবাইম, ইনশাল্লাহ।’ তাঁর এই বিশ্বাসী মনের কাছে যেন নিষ্প্রভ হয়ে গেল কৃত্রিম আলোর এ শহর!

এমন আত্মবিশ্বাস, এমন ভরসায় থাকার মনস্তত্ত্বই কি আবুল বাশারদের জীবনের জ্বালানি, বেঁচে থাকার অক্সিজেন?

প্রতিটি শব্দের সঙ্গে হাসি যোগ করার ক্ষমতা রাখা মানুষটির বাড়ি নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার ফুলপুর গ্রামে। ‘ফুলপুর’ যাঁর বাড়ি, তিনি শুধু ফুলের সুবাস পাবেন, কাঁটার খোঁচা খাবেন না, তা তো হয় না! আবুল বাশারকেও জীবনে কম কাঁটার আঘাত সইতে হয়নি, কিন্তু তাঁর ‘জীবনদর্শন’ তাঁকে অবিচল যেমন রাখে, তেমনি ‘সন্তুষ্টি’ নিয়ে রোজ রাতে ঘুমাতে যান তিনি। তাঁর কথা পরিষ্কার, তিনি এখন মারা গেলে তাঁর বড় ছেলে জানাজার নামাজ পড়াতে পারবেন, আর কী চাওয়ার বাকি থাকতে পারে তাঁর!

আবুল বাশারের এমন কথার পিঠে অনেক কথাই বলা যায়, যুক্তি খাড়া করা যায়, কিন্তু তাঁর সারল্যের কাছে, এমন নির্বস্তুক চাওয়ার কাছে পুঁজির পেছনে ছুটতে থাকা পৃথিবী কি একটুখানি হলেও হেরে যায় না!

যে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য ছাপা হয় পত্রপত্রিকায়, একশ্রেণির মানুষের সম্পদবৃদ্ধির পরিমাপ প্রচলিত কোনো পদ্ধতিতেই সম্ভব হয়ে ওঠে না, সেই দেশের এক ব্যক্তি দিনে পাঁচ-ছয় শ টাকা আয়েই অনায়াসে ‘শুকরিয়া’ বলতে পারেন—এই বৈপরীত্যকে আপনি যেভাবেই ব্যাখ্যা করুন না কেন, আবুল বাশারকে ‘বোকা’, ‘ব্যাক-ডেটেড’ বা এ রকম যা খুশি বলে দাগিয়ে দিন না কেন, খোলা প্রান্তরের মতো, মাটির ঘ্রাণের মতো, বাতাসের বয়ে চলার মতো তিনি অকপট, সরল।

পুরোপুরি অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষটি এত সহজ-সরল জীবনবোধ কীভাবে রপ্ত করলেন, তা তাঁর কথা শুনে বিস্ময় আরও বাড়ে বৈ কমে না।

তিন ছেলেকেই মাদ্রাসায় দিয়েছেন। বড়টির বয়স ১৭ বছর, মেজ ১৩ আর ছোটটির ১০। জমি আছে আট কাঠা। বিয়ের আগে কৃষিকাজ করতেন, মানে অন্যের জমিতে কামলা দিতেন। আয় যা হতো, সব বাবার হাতে তুলে দিতেন, সেই টাকা থেকে বাবা তাঁর নামে ওই জমি কিনে দিয়েছেন। এরপর আর এক ছটাকও বাড়াতে পারেননি। মাঝে পেটে কী এক ব্যামো হয়, দুই দফায় অস্ত্রোপচার করতে হয়। সেই থেকে ভারী কাজ বন্ধ। চলে আসেন ঢাকায়। ফলফলাদি ফেরি করে বিক্রি শুরু করেন। তবে ২০-২২ কেজির বেশি বহন করতে পারেন না।

দিন শুরু হয় সকাল ছয়টায়। মধ্যবাড্ডার মেস থেকে চলে যান কারওয়ান বাজারে, মালামাল কেনেন। এরপর কোনো হোটেলে নাশতা করে বেরিয়ে পড়েন ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে। এ পাড়া-ও মহল্লা হয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি শেষে রাত ১১টা-১২টায় মেসে ফেরেন।

আবুল বাশার জানান, আট কাঠা জমিতে ফসল ফলান তিনি। প্রতি মাসে তিন ছেলের মাদ্রাসার খরচ মোটামুটি আয় করতে পারলেই বাড়িতে যান। মাদ্রাসার শিক্ষকেরা তাঁর হালত জানেন, তাই অনেকটাই ছাড় দেন। মেসে থাকতে লাগে দেড় হাজার টাকা। তিন বেলা খাওয়ার খরচ মোটামুটি দুই শ টাকা।

আবুল বাশারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল রামপুরা টেলিভিশন সেন্টারের বিপরীত পাশের ফুটপাতে। জীবনের ‘ব্যবহারিক শিক্ষায়’ টাকাটা দেখে চিনতে শিখেছেন শুধু, কিন্তু সংখ্যা-অক্ষর কিছুই চেনেন না। তাই কোনো হিসাবও ‘সঠিক’ বলতে পারেন না। যেমন বয়স বললেন ৪০-৪৫ হবে। বয়স যা-ই হোক, তাঁর সারল্যের কাছে মাথা নত না হয়ে পারে না!

Scroll to Top