নিজস্ব প্রতিবেদক :
প্রতি বছর জুন মাসে জাতীয় ফল মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ‘ফল সম্ভার’ বই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ সংস্থা কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) এ বই মুদ্রণের পর তা মেলায় আগতদের সরবরাহ করে। গত বছর (২০২৩) ফল মেলা অনুষ্ঠিত না হলেও ফল সম্ভার বই ঠিকই প্রকাশিত হয়েছে। তবে তা বাস্তবে নয়, কাগজে-কলমে। এআইএসের কর্তা বাবুরা ‘ফল সম্ভার’ বই প্রকাশের ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা লোপাট করেছেন।
খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) ও এআইএস কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, প্রতি বছর ১৬-১৮ জুন খামার বাড়ির পাশে জাতীয় ফল মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিয়মিত এ মেলা অনুষ্ঠিত হলেও মহামারী করোনার সময় ও পরবর্তীতে (২০২২ হয়েছে) আর মেলা হয়নি। তাই ফল সম্ভার নামের ওই বই প্রকাশেরও প্রয়োজনীয়তা পড়েনি। কিন্তু এআইএসের কর্তা বাবুরা ঠিকই তিনটি কোটেশনে মোট ৮ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৯ টাকার বিল ভাউচার তৈরি করে গত জুলাই মাসে তা উত্তোলন করেছেন। ১২৮ পৃষ্ঠার এই বই তিনটি আলাদা কোটেশনে যথাক্রমে ৮৯০ কপি (২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৭ টাকা), ১০৬০ কপি (২ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৭ টাকা) এবং ১০৬০ কপি (২ লাখ ৯৫ হাজার ৪৭৫ টাকা) মুদ্রণ ব্যয় দেখিয়েছেন।
খামারবাড়ি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফল সম্ভার বই মূলত ফল মেলায় আগতদের কাছে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে। খামারবাড়িসহ আঞ্চলিক অফিসগুলোতে এ বই পাঠানো হয়। গত বছর এ বই কেউ দেখেনি। তারা বলছেন, যেহেতু ফলমেলাই হয়নি, সেখানে ফল সম্ভার বই ছাপানোর তো প্রয়োজনীয়তাই থাকে না। এআইএসের তৎকালীন প্রধান তথ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো: আবু জাফর আল মুনছুর এসব গায়েবি বিলে স্মাক্ষর করেছেন।
এআইএসের বিভিন্ন শাখা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে আলাপ করেও ২০২৩ সালে কথিত প্রকাশিত ‘ফল সম্ভার’ বইয়ের হদিস পাওয়া যায়নি। গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগ অফিসার মো: পারভেজের সাথে তার রুমের সামনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তার সাথে আরো তিনজন ছিলেন। পারভেজের কাছে গত বছরের ফল সম্ভার বই চাওয়া হলে তিনি জানান, ফল মেলাই হয়নি, আবার বই কোথা থেকে আসবে? গতকাল সোমবার দুপুরে এআইএসের প্রেরক দফতরে গিয়ে-সারোয়ার জাহানের রুমে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তার কাছে বই চাইলেও তিনিও একই কথা বলেন। করোনার পর ফলমেলা হয়নি, তাই এ সংক্রান্ত কোনো বইও প্রকাশিত হয়নি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে মনিটরিং উইংয়ের উপপরিচালকের দায়িত্বে থাকা মো: আবু জাফর আল মুনছুরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথমে স্বীকার করেন করোনা ও করোনা পরবর্তী সময়ে কোনো ফলমেলা হয়নি। তিনি বলেন, যতদিন ফলমেলা হয়েছে ততদিন ‘ফল সম্ভার’ বই বের হয়েছে। তাহলে গত বছর ‘ফল সম্ভার’ নামে বই প্রকাশের বিল ভাউচার করা হলো কী করে? যেখানে আপনার স্বাক্ষর রয়েছে? এমন প্রশ্ন করতেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে পাল্টে ফেলেন জবাব। তিনি তখন বলেন, বই প্রকাশ হয়েছে কি না- সবগুলো বিল ভাউচার না দেখে বলতে পারব না। অল্প পরিসরে ১০০ বা ২০০টি বই ছাপা হতে পারে। তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি প্রকাশনা পেন্ডিং ছিল। দেখবেন যে ওখানে (এআইএস-প্রকাশনা দফতরে) কয়েক দিনের মধ্যে বই চলে আসছে।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. সুরজিত সাহা বলেন, ‘গত বছর (২০২৩) বই প্রকাশ হয়নি। আগের বছর কিছু হয়েছিল, সেগুলো শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে কিছু করার প্রক্রিয়া ছিল। এখন পর্যন্ত প্রিন্ট হয় নাই। লেখাগুলো রেডি করতে দেরি হচ্ছিল। ওইটা আমরা জুনে (২০২৩) বিল করে রেখেছি, এটা প্রসেসিংয়ে আছে। প্রেস ম্যানেজার ভালো বলতে পারবে, কী অবস্থায় আছে।’
জানা যায়, বিভিন্ন ফলের পরিচিতি ও গুণাগুণ উল্লেখ করে কালার ছবিসহ ‘ফল সম্ভার’ বইটি মুদ্রণ করে তা মেলায় বিতরণ করে এআইএস। বইয়ের ভেতরে সবকিছু ঠিক থাকলেও ওপরের মলাটের ডিজাইন ও সাল পরিবর্তন করে এটা করা হচ্ছিল। ২০২০ সালে করোনা শুরুর পর শুধু ২০২২ সালে ছোট পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়েছে মেলা। খামারবাড়ি একাধিক সূত্র বলছে, তখন খুব অল্প সংখ্যক এ বই মুদ্রণ করা হয়।
সূত্র জানায়, এআইএসের সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলার পরপরই কিছু সংখ্যক বই প্রকাশ করার তোড়জোড় শুরু হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রাতের আঁধারে কিছু সংখ্যক ফল সম্ভার বই মুদ্রণ করে এআইএস-এ রাখা হয়েছে। অনিয়মকে ঢাকতে সংশ্লিষ্টরা আরেকটি অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে স্টোরকিপার (প্রেস) ইশরাত জাহান খান কথা বলতে রাজি হননি। কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি এআইএস প্রেস ম্যানেজার খন্দকার জান্নাতুল ফেরদৌসও। সূত্র জানায়, ‘ফল সম্ভার বই আগে কিছু ছাপানো হয়েছিল এবং এখন নতুন করে কিছু ছাপানো হয়েছে’- সংশ্লিষ্টরা এমন স্ট্র্যাটেজিতে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ বলছেন, বইগুলো ব্যাক ডেটে স্টক দেখাতেও চেষ্টা চলছে।