মোহাম্মদ আরিফুর রহমান
রফতানি-সংক্রান্ত একটি খবর নজরে এসেছে। খবরটি হলো, পণ্য রফতানিতে খাতভেদে সরকার ১০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা কমিয়েছে। এর মধ্যে কৃষিপণ্য নগদ সহায়তা ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। মূলত এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছে। উন্নত দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ নেয়া ছাড়া বিকল্প নেই। উন্নয়ন ভাবনার ব্যক্তিরা বলছেন, রফতানি প্রতিযোগিতা বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি নগদ সহায়তা কোনো সমাধান নয়।
রফতানি খাতে সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে এ খাতে জড়িত ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা যেমন চিন্তায় পড়ছেন তেমনি উত্তরণের পথও খুঁজছেন। আমি যেহেতু কৃষি নিয়ে কাজ করছি, কৃষি ভাবনাটাই আমাকে তাড়িত করে। কয়েক বছর ধরে রফতানিমুখী কৃষি বাংলাদেশের কৃষিতে আলো দেখাচ্ছিল। আমরাও আশা দেখছি। গত বছর কৃষিপণ্য রফতানির পরিমাণ ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার ছিল, এটি বাড়ার একটি প্রবণতা আমরা গত ছয় (জুলাই-ডিসেম্বর) মাসে দেখতে পেয়েছি। গত ছয় মাসে একমাত্র কৃষিই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছিল। জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউরোপে ৪ হাজার ২১০ টন শাকসবজি ও ফলমূল রফতানি হয়েছে। রফতানি বাড়ার অব্যাহত ধারায় এ খাতসংশ্লিষ্টরা আলোর আভা দেখছিলেন।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের জনগণের খাদ্যাভ্যাস এবং কৃষিজ পণ্য উৎপাদনচিত্র প্রায় কাছাকাছি। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উপমহাদেশের জনগণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সারা বিশ্বে উপমহাদেশের জনগণ বসবাসের সংখ্যা নেহাত কম নয়। অনেকে আবার পরিবারসহ বাস করছেন। উপমহাদেশের জনগণ খাদ্যাভ্যাস খুব একটা পরিবর্তন করতে চান না। প্রবাসে বসেও তারা দেশীয় খাবার খেতে পছন্দ করেন। দেশীয় খাবার খোঁজেন, সংগ্রহ করেন। প্রবাসীদের মতোই স্থানীয় বিদেশীরাও উপমহাদেশের খাদ্যের প্রতি একটু একটু দুর্বল হচ্ছে। বিশেষ করে উপমহাদেশের আম, লেবুসহ বেশকিছু প্রচলিত/অপ্রচলিত সবজি ও ফলের প্রতি।
বাংলাদেশ থেকে শতাধিক ফল ও সবজি বিদেশে রফতানি হয়ে থাকে। আম, জারালেবু, সাতকড়া, জাম্বুরা, পান, জলপাই, কাঁঠাল, কঁচু, আমলকী, ডেউড়া, লুকলুকি, শালুক, শুকনা বড়ইসহ অনেক অপ্রচলিত এবং প্রচলিত ১০৭ ধরনের কৃষিজ পণ্য। রফতানিকারকরা সারা দেশ ঘুরে ঘুরে এসব পণ্য সংগ্রহ করেন। তাদের কিছু সোর্স এবং বিশ্বস্ত কৃষক এসব পণ্যের জোগান দেন। অনেক রফতানিকারকের কিছু চুক্তিবদ্ধ কৃষক রয়েছেন। চুক্তিবদ্ধ কৃষকরা চাহিদা অনুসারে পণ্য উৎপাদন করে সরবরাহ করে থাকেন। নরসিংদী, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁর বেশকিছু কৃষক রফতানির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বর্তমানে কৃষি শ্রমিকের অপর্যাপ্ততা, কৃষি উৎপাদন উপকরণের ব্যয় বৃদ্ধি, পরিবহন খরচসহ মধ্যস্থতাভোগীদের অতিরিক্ত চাহিদার কারণে মানসম্মত কৃষিপণ্যের দরবৃদ্ধির বিষয়টা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। সরকারি দপ্তরগুলো প্রতিনিয়ত এ ব্যয় হ্রাসের চেষ্টা অব্যাহত রাখছে। যখনই রফতানির বিষয়টি সামনে আসে তখন পণ্যের নিরাপত্তা, বাছাইকরণ, প্যাকেজিংসহ গুণগতমান বজায় রাখার কারণে এসব পণ্যের দাম অন্যান্য পণ্যের চেয়ে স্বভাবতই বেশি হয়। এছাড়া রফতানির ক্ষেত্রে পণ্য উড়োজাহাজীকরণ ব্যয়, উন্নত প্যাকেজিং এবং গুণগতমান বজায় রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বর্তমান ব্যয় প্রতিবেশী অন্য দেশের তুলনায় কিছুটা বেশি। পণ্যের উৎপাদন পর্যায়ে কৃষককে সহায়তা করা গেলে বিশেষত যেসব কৃষক ডেডিকেটেডলি রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদন করবে সেসব কৃষকের উৎপাদন পর্যায় উপকরণ সহায়তাসহ অর্থাৎ বিশেষ মূল্যে উৎপাদন উপকরণ সরবরাহ করা গেলে মানসম্মত পণ্য প্রতিযোগিতা মূল্যে উৎপাদনে সক্ষম হতে পারত। এক্ষেত্রে বিদেশী ক্রয়কারীরাও এগিয়ে আসতে পারেন। বিশেষ করে নিরাপদ পণ্য উৎপাদনের স্বার্থে জৈব বালাইনাশক, ফ্রুট ব্যাগিং, মালচিং সিট এবং আধুনিক উৎপাদন প্রযুক্তি উপকরণ সহায়তা হিসেবে কৃষকদের সরবরাহ করা গেলে কৃষকের উৎপাদন খরচ কমে আসবে।
জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, লবণাক্ততা, সেচের অভাব ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতার পরও বাংলাদেশের কৃষকরা ফসল উৎপাদনে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে গুণগত মানের পণ্য উৎপাদনের দিকে। বাংলাদেশে কৃষি গবেষণায় আরো মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। বেশকিছু ফসলের গবেষণাপ্রাপ্ত উৎপাদনের সঙ্গে মাঠের উৎপাদনে হেরফের রয়েছে। গবেষণা মাঠের উৎপাদন এবং কৃষকের মাঠের উৎপাদনের পার্থক্যটা কমিয়ে আনা প্রয়োজন। গবেষকদের খুঁজে বের করতে হবে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বল্প জায়গায় অধিক উৎপাদন করে উৎপাদন ব্যয় হ্রাস করা। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে তাল মিলিয়ে কৃষিপণ্য রফতানি বাণিজ্যের সাফল্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার একমাত্র অবলম্বন হলো মানসম্মত পণ্য উৎপাদন, উৎপাদন ব্যয় হ্রাস, পণ্য সংগ্রহোত্তর উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি নতুন বাজার অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা গেলে রফতানির উল্লম্ব ধারাটা বজার রাখা সম্ভব হবে।
লেখক: প্রকল্প পরিচালক-রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প, ডিএই, কৃষি মন্ত্রণালয়